শোকের মাসে যত শোক

 শোকের মাসে যত শোক 


রক্তঝরা আগস্টকে বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস বা মৌসুম বলাটা নানাবিধ কারণে যথাযথ বলেই হয়ত বহুকাল ধরে এ একত্রিশ দিনকে শোক হিসেবে পালন করে আসছে দেশবাসী। এ মাসে সবচেয়ে বড় শোক নিসন্দেহে জাতির অগ্রনায়কের নারকীয় হত্যাকাণ্ড যার কারণে অনেকটাই আড়ালে চলে যাচ্ছে অন্যান্য শোকের মুহূর্ত গুলো৷ আমাদের আজকের এ পর্বে আমরা সেসকল শোকের মুহূর্তগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব যেগুলো এ দেশের জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতির কারণ 


১) সাত আগস্ট ১৯৬১ঃ 


"আজ হইতে শত বর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি "

- ১৪০০ সাল ( চিত্রা), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 


১৯৬১ সালে শতবর্ষ পালনের পর ২০১১ সালে সার্ধশতবর্ষও পালিত হয় এ মহান কবির। ২০০৪ সালে করা বিবিসি র জরিপে সর্বকালের সেরা বাঙ্গালীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা, সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, ও হাজার গানের সুরশ্রষ্ঠা। 

মহাত্মা গান্ধী সাহেব কতৃক ঘোষিত "গুরুদেব" জন্ম গ্রহন করেছিলেন ১৮৬১ সালের ৭ ই মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে৷ মাত্র তের বছর বয়সেই সে অবদান রেখেছিলেন বাংলা সাহিত্যে যার ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন অঙ্গন নাই যেখানে তার অবদান নেই আর এমনই একজন মানুষকে আমরা হারিয়েছে ১৯৪১ সালের এ আগস্টের ৭ তারিখ৷


তাকে নিয়ে আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভূল ধারণা রয়েছে যে তিনি নজরুলের বিরোধিতা করেছিলেন যদিও বাস্তবিক অর্থে তার কোন প্রমান তার কাজে কর্মে পাওয়া যায় নি বরং সে বিভিন্ন সময় নজরুলের পক্ষ হয়ে অন্যান্য সাহিত্যিকদের বিরোধিতা করেছেন৷একবার নজরুল কোন কারণে জেলে অন্তরীন থাকাকালীন সময়ে তাকে রবি ঠাকুর "বাসন্তী " নামক কাব্যটি তার জন্য উপহার হিসেবে পাঠায় যা নজরুলকে কিছুটা হলেও শান্তি দিয়েছে৷ এর কদিন পর নজরুল টানা ১৪ দিনের অনশনে যায় এ সময় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে টেলিগ্রাম লিখেন 


- " অনশন ছেড়ে দাও, 

আমাদের সাহিত্যে তোমাকে দরকার"।


১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ঃ

শুধুই আগস্ট নয়, সারা বিশ্বে এ যাবৎকাল পর্যন্ত  ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল এ মাসেই। ১৫ আগস্ট রাতে কয়েকজন বিপদগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তার হাতে নির্মমভাবে খুন হন জাতির অগ্রনায়ক সহ তার পুরো পরিবার।বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা ছাড়াও তার তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ও শিশু পুত্র শেখ রাসেলকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন পড়ালেখার কাজে দেশের বাহিরে অবস্থান করায় বেচে যায় তার দু মেয়ে বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রপথিক শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা৷ শুধু নিজের পরিবারই নয় - এ হত্যাকাণ্ডে হত্যা করা হয়েছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সদস্যদেরও 


 এ ক্ষতি নিসন্দেহে দেশের জন্য একটি অপূরনীয় ক্ষতি - তিনি বা তারা জীবিত থাকলে হয়ত আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হত না। আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা জাতির এমন স্বপ্নদ্রষ্টাকে অকালেই হারিয়েছি৷ 


১৭ ই আগস্ট ২০০৫ঃ

দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর এ দেশ যখন পুনরায় গনতন্ত্রের দিকে ফিরে আসছে তখনই একদল চক্রান্ত করছিল এ দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। তারই ধারাবাহিকতায় এ দেশের জঙ্গিবাদের বীজ বপন শুরু করেছিল এক এক করে। ক্রমান্বয়ে হতে থাকা জঙ্গি হামলার এক পর্যায়ে সারা বাংলাদেশে এক সাথে সিরিজ বোমা হামলা করে ৬৩ টি জেলার( মুন্সিগঞ্জ বাদে) ৩০০ স্থানে ৫০০ টিরও বেশি বোমা হামলা করা হয় যাতে নিহত হয় কমপক্ষে ২ জন এবং আহত হন ২০০ ও বেশি মানুষ। এসময় মূল টার্গেট ছিল সরকারি বিচার বিভাগের স্থাপনাসমূহ। প্রতিটি জেলার আদালতগুলোতে তারা হামলা চালিয়ে প্রচায় করতে থাকে যে, এ দেশে ইসলামি আইন চালু করতে হবে অচিরেই। 

 এটি বাংলাদেশের একটি কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসের পাতার থাকবে চিরকাল 


২১ আগস্ট ২০০৪ঃ 

বাংলাদেশ ও আওয়ামিলীগ এর ইতিহাসে আগস্ট সবসময়ই একটি ভয়ানক মাস। ২১-এ আগস্টও তার একটি - এদিন বিকেল বেলা ৭ আগস্ট সিলেটে বোমা হামলার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামিলীগ সভানেত্রীর প্রতিবাদী সভাস্হলে গ্রেনেড হামলা হয় যাতে অল্পের জন্য প্রানে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাগ্যক্রমে প্রধানমন্ত্রী বেচে গেলেও ৩০০ ও বেশি নেতাকর্মী আহত হওয়ার পাশাপাশি নিহত হন কমপক্ষে ২৪ জন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এর সহধর্মিণী আইভি রহমান সহ আরও অনেকে৷ প্রধানমন্ত্রীর উপর এ নিয়ে ২১ বার হামলা হয়েছিল, আল্লাহ র অশেষ রহমতে তিনি এখনও আমাদের মাঝে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন৷ 


২৯ এ আগস্ট ১৯৭৬ঃ আগস্ট যেন আমাদের কোনভাবেই ছাড়ছে না - একের পর এক শোক ভর করছে এ মাসেই। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনক কাজি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তার চিকিৎসার সকল বন্দোবস্ত করেন। চল্লিশের দশকের পর থেকে তিনি একপ্রকার অচল থাকলেও বাংলা সাহিত্যে নিয়মিত অবদান রেখে যাচ্ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷ কিন্তু ১৯৭৬ সালের ২৯ এ আগস্ট তার কলম থেমে যায়। বাংলা সাহিত্যের কয়েক হাজার গান, কবিতা, গল্প উপন্যাস আজও বাংলা সাহিত্য প্রেমীদের প্রেমের বিষয় হয়ে আছে। তার হারিয়ে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও পূরণ হয়নি।


- smkiiuc@gmail.com

শোকের মাসে যত শোক শোকের মাসে যত শোক Reviewed by সার্থান্বেষী on আগস্ট ১২, ২০২০ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Copyright 2020, All Rights Reserved by Blog Sarthanweshi

Blogger দ্বারা পরিচালিত.