মেহরাব নয়নের রহস্য গল্প - "ইন্দ্রিয় লালসা-৩"

ইন্দ্রিয় লালসা-- পার্ট- ৩

মুন্নার সাথে কথা শেষ করে নেক্রোফিলিয়া সম্পর্কে আরেকটু ঘাটাঘাটি করলাম। যেটা দেখলাম তা দেখে আমার হৃদপিণ্ডের কম্পনটা আরো বেড়ে গেলো।
'নেক্রোফিলিয়া', যেটাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ংকর মানসিক রোগ। পৃথিবীর সবচাইতে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার কে জানেন?
আমেরিকার "টম বান্ডি"।
যে কি'না এই নেক্রোফিলিয়া'তেই আক্রান্ত ছিলো। শুধুমাত্র তার নিজের বয়ান অনুযায়ী ৩০জন মানুষকে সে খুন করে শারীরিক সম্পর্ক করেছে।
কিন্তু আসল সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।
আমার বুকটা ধুক ধুক করছে।
বাংলাদেশে এমন পৈশাচিক রোগ?
বাংলাদেশে এমন সিরিয়াল কিলার?
কে?
আরিফ সাহেব?
না'কি ওই দুইজন মানুষের মধ্যে কেউ, যারা দেখা করতে এসেছিলো মায়া হকের সাথে।
না'কি রাজু নিজেই"?
উত্তরটা আমাকে জানতেই হবে।
.

নেক্রোফিলিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে আরেকটু জানার আগ্রহ বাড়লো।
আমি ফ্রান্সের " ভিক্টর আর্ডিসন" এর ঘটনা পড়লাম। এই মানুষটা খুন করেছে মাত্র ১টা। তাও আবার তার স্ত্রী'কে।
কিন্তু প্রায় ১০০টা লাশের সাথে সে শারীরিক সম্পর্ক করেছে।
শুধু তাইনা, লাশের মাথা কেটে এনে সে তার নিজের কাছে রাখতো।
কাটা মাথায় লিখতো 'আমার বউ'।
কাটা মাথাটা'কে সে নিজের বউ ভেবে গল্প করতো। কথা বলতো।
কিন্তু যখন লাশের মাথাগুলো কোনো উত্তর দিতোনা, সে রাগ করে কাটা মাথাগুলো আরো বিভৎস করে দিতো।
কতোটা ভয়ংকর ভাবা যায়?
পরে 'ভিক্টর আর্ডিসন'কে আজীবনের জন্য মানসিক হসপিটালে পাঠানো হয়।
.
এসব জানার পর আমার শরীরটা ঝিনঝিন করে উঠলো।
মুহুর্তেই মনে হলো শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছিনা। দূর থেকে একবার রাজুর দিকে তাকালাম। ভয় লাগছে।
এই রোগ হলে নিজের মা'কে এভাবে খুন করাটাও অসম্ভব না।
কিন্তু পরক্ষণেই আমার মনে হলো, এই ধরনের রোগী'তো খুন করার পর লাশের কিছু জিনিস স্মৃতি হিসাবে সাথে করে নিয়ে যায়। মায়া হকের চুড়ি, চেইন, এগুলোও নিয়ে গেছে।
কিন্তু আমরা রাজুর কাছে এসব কিছুই পাইনি। হসপিটালের কেভিনেও কিছু খুঁজে পাইনি। তারমানে রাজু খুনি হতে পারেনা। আমি তাড়াতাড়ি হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা সিসিটিভি ফুটেজ'গুলো নিয়ে রাজুর কাছে গেলাম। রাজুকে পুরো ভিডিও দেখালাম। বললাম,
–ভালো করে দেখো, শেষে যে দুইজন মানুষ তোমার আম্মুর সাথে দেখা করতে এসেছেন উনাদের চিনতে পারো কি'না"?
রাজু ফুটেজগুলো দেখে বললো,
–মেহরাব স্যার, রাত সাড়ে ১০টায় যে মানুষটা এসেছিলেন, উনি আমাদের আগের ভাড়াটিয়া। উসমান সাহেব।
আমার নানা আম্মুর নামে দুইটা ফ্ল্যাট সহ কয়েকটা জমি রেখে যান। একটা ফ্ল্যাটে এই উসমান সাহেব ভাড়া থাকতেন"।
–থাকতেন মানে? এখন আর থাকেন না"?
–না স্যার। বছর'খানেক আগেই উনাকে আম্মু ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেন।
আসলে উনি আম্মুর দিকে খারাপ নজরে তাকাতেন। একদিন আম্মুকে খারাপ প্রস্তাব দেওয়ায় আম্মু রাগ করে উনাদের বের করে দেন। উসমান সাহেবের স্ত্রী কথাটা শুনে উসমান সাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান।
এতোদিন পর উসমান সাহেব আম্মুর সাথে দেখা করতে আসলেন কেনো বুঝতে পারছিনা"।
–হতে পারে সেই প্রতিশোধ নিতে।
বাদ দাও এসব। অন্যজন কে"?
–স্যার রাত সাড়ে ১১টায় যিনি এসেছেন উনি করিম চাচা।
আমাদের বাসায় আগে কাজ করতেন।
কয়েক'মাস আগে কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে যান। কেনো কাজ ছেড়ে চলে গেলেন সেটা আমি জানিনা। কিন্তু উনি আম্মুর সাথে হসপিটালে দেখা কর‍তে আসলেন কেনো"?
'দেখা করতে আসলেন কেনো'?
রাজুর এই প্রশ্নটার ভিতরেই হয়তো সব রহস্য লুকিয়ে আছে।
উসমান সাহেব এবং করিম, এই দু'জনের সাথে খুনটার কিছু তো কানেকশন আছে নিশ্চিত।
আমি রাজুকে বললাম,
–উনারা কেনো আসলেন এটার খোঁজ আমি নিয়ে নিবো। তুমি চিন্তা করিওনা"।
.
রাজুর সাথে কথা শেষ করে চলে আসছি ঠিক এমন সময় রাজু পিছন থেকে ডাক দিলো,
–মেহরাব স্যার একটা কথা বলি"?
–হ্যা বলো"।
–স্যার উনারা দুইজন কেনো আসলেন এটা তো আমি জানিনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত উনারা দুইজন এই খুনের সাথে জড়িত নয়। আমার সন্দেহ আরিফ সাহেবের উপর। আপনি আরিফ সাহেবকে কেনো ধরছেন না? উনার স্ত্রী মেয়ে খুন হলো অথচ তার কোনো খবর নেই? উনি লাপাত্তা কেনো? খোঁজ নিন স্যার, এই মানুষটাই আমার আম্মুকে খুন করেছে"।
আমি রাজুর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। আসলেই তো! খুনের রাত থেকে একের পর এক আরিফ সাহেবকে কল দেওয়া হচ্ছে। নাম্বার সুইচ অফ!
গেলেন কোথায় উনি?
উসমান এবং করিমের বিষয়টা পরে দেখা যাবে। আগে আরিফ সাহেবকে খুঁজে বের করাটা জরুরী।
.
.
অনেক চেষ্টার পর আরিফ সাহেবকে খুঁজে পেলাম কক্সবাজারে।
উনি একা নয়, সাথে একজন নারী।
জিজ্ঞাস করার পর জানতে পারলাম মেয়েটার নাম নিশি। আরিফ সাহেবের গার্লফ্রেন্ড। নিশিকে বললাম,
–তুমি জানতেনা আরিফ সাহেব বিবাহিত? উনার একটা মেয়ে আছে"।
নিশি বললো,
– স্যার, ভালোবেসে ফেলেছি আরিফেকে। তাছাড়া আরিফ আমাকে বলছে খুব তাড়াতাড়ি ওদেরকে সরিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। গতকাল রাতেও বলছিলো 'আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো। ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে'।
আমি জানি স্যার ওই মহিলার সাথে আরিফ সুখী নয়। আরিফ আমাকে ভালোবাসে। আমিও আরিফকে ভালোবাসি। কিন্তু আপনি এখানে আসলেন কেনো? আরিফ কিছু করেছে"?
আমি নিশির কথার কোনো উত্তর দিলাম না। এই মেয়েটার সাথে এই কেসের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু না বলেই ওইখান থেকে আরিফকে ধরে থানায় নিয়ে আসলাম।
.
.
আমার সামনে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন আরিফ সাহেব। নিঃশব্দ।
এমন একটা ভাব নিচ্ছেন যেনো উনি কিছুই জানেন না।
আমি বললাম,
–এইখানে আপনার স্ত্রী আর মেয়ে খুন হয়ে গেলো, আর আপনি কক্সবাজারে নষ্টামি করছেন? লজ্জা লাগেনা"?
আরিফ সাহেব বড়বড় চোখে আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো প্রচন্ড শকড খেয়েছেন। অবাক কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন,
–মানে? কি বলছেন এসব"?
–যা শুনলেন সেটাই বললাম। আপনি যেদিন রাতে উনাদের সাথে হাসপাতালে দেখা করেন, ওইদিন রাতেই মায়া হক এবং আপনার মেয়ে সামিয়া খুন হয়।
এখন আমাকে এটা বলুন, ওইদিন রাত থেকেই আপনি লাপাত্তা কেনো?
আপনার নাম্বার সুইচ অফ কেনো"?
আরিফ সাহেব কথাটা শুনামাত্র'ই চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। উনার চোখগুলো মুহুর্তেই টলমল করতে শুরু করলো। আমাকে বললেন,
–আমার মেয়ে মারা গেছে"?
–কি অদ্ভুত আরিফ সাহেব। আপনার স্ত্রী'ও কিন্তু খুন হয়েছেন। উনার কথা কিছু জিজ্ঞাস না করে মেয়ের মারা যাওয়ার খবর শুনে অবাক হলেন?
বাদ দিন এসব। আমাকে এটা বলুন ওইরাতে আপনি হসপিটালে এসেই চলে গেলেন কেনো? সেই সাথে ওই রাত থেকেই আপনার নাম্বার সুইচ অফ কেনো?
কোথাও এরকম নয়'তো আপনিই ওদের খুন করেছেন।
আপনি'ই নেক্রোফিলিয়াতে আক্রান্ত"।
আমার কথাটা শুনে আরিফ সাহেব রেগে গিয়ে চিল্লায়া উঠলেন,
–কি সব আজেবাজে কথা বলছেন।
নেক্রোফিলিয়া কি? আর আমি কেনোই বা আমার স্ত্রী মেয়েকে খুন করতে যাবো? রাতে আমি হাসপাতালে থাকিনি কারণ সামিয়ার অসুখটা ততোটা বড় ছিলোনা। সামান্য ব্যাথা ছিলো বুকে।
আর তাছাড়া আমার গার্লফ্রেন্ড নিশির সাথে ওই রাতেই আমার কক্সবাজার আসার প্ল্যান ছিলো। কক্সবাজার আসার পথে আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে যায়।
এজন্য আমার নাম্বারটা সুইচ অফ ছিলো।
এখানে এতকিছু হয়ে গেছে আমি'তো এসব জানতাম'ই না। তাছাড়া হাসপাতালে তো আমার স্ত্রী আর মেয়ের সাথে রাজু ছিলো। এই রাজুই হয়তো আমার স্ত্রী আর মেয়েকে খুন করেছে"।
–উহহু! রাজু কিছু করেনি এটা নিশ্চিত।
খুনটা আপনিই করেছেন। আর আপনার স্ত্রী'কে খুন করার জন্য আপনার কাছে অনেকগুলো কারণ আছে। আপনি চাচ্ছিলেন নিশি মানে আপনার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে।
এবং তাকে বলেও ছিলেন 'খুব তাড়াতাড়ি সব ঝামেলা দূর করে তাকে বিয়ে করবেন'। আপনি সেটাই করলেন। এমনিতে চাইলেই মায়া হককে ডিভোর্স দিয়ে আপনার প্রেমিকা'কে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু এরকম হলে মায়া হকের দুইটা ফ্ল্যাট, সাথে কয়েক কোটি টাকার জমি আপনার হাতছাড়া হয়ে যেতো।
আর লাশ দেখলে তো আপনার মাথা ঠিক থাকেনা। তাই খুন করার পর লাশের সাথে এই নোংরামি করলেন।
কিন্তু এটা বুঝতে পারছিনা আপনার মেয়েকে খুন করলেন কেনো"?
আমার কথাগুলো শুনে আরিফ সাহেব কিছু বলছেন না। রাগে ফুসফুস করছেন। মনে হচ্ছে এখন ই কাউকে খুন করে দিবেন।
আমি আবার বললাম,
– রাগ না দেখিয়ে যেটা সত্যি স্বীকার করে নিন আরিফ সাহেব"।
আরিফ সাহেব প্রচন্ড জোরে চিল্লায়া উঠলেন,
–কি স্বীকার করবো আমিইই?
কি বলবো? আমি বলছিনা আমি খুন করিনি আমার স্ত্রী আর মেয়েকে।
আমি ওই রাতেই কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এবং সকাল হওয়ার আগেই কক্সবাজার পৌছে যাই।
আমি সারারাত রাস্তায় ছিলাম।
আপনি চাইলে আমি হাজারটা প্রমাণ দিতে পারবো। আর কি বললেন, লাশের সাথে কি? কি'রকম নোংরামি? আমার মেয়ের লাশের সাথে কে কি করেছে?
বলুন আমাকে"?
.

আরিফ সাহেব চিল্লাচ্ছেন। উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এই বিষয়ে উনার কোনো ধারণাই নেই। এটার মানে হচ্ছে আরিফ সাহেব খুনটা করেন নি।
কিন্তু আরিফ সাহেব খুনটা না করলে আর কে করবে?
এসব ভাবছি ঠিক এমন সময় আমার ফোনটা বেঁজে উঠলো। ডাক্তার শামীমের কল। ধরলাম। ডাক্তার শামীম বললেন,
–মেহরাব স্যার, এইমাত্র নার্স শারমিনের বাসা থেকে আমার কাছে কল এসেছে। কেউ শারমিনকে খুন করে ফেলেছে স্যার। নার্স শারমিন সেই মেয়ে, যে রাজুকে ছুরি হাতে দেখে সবার আগে চিৎকার করেছিলো।
আমার ভীষণ ভয় লাগছে স্যার।
আপনি প্লিজ ওদের বাসায় আসুন।
আমরাও ওইখানে যাচ্ছি"।
.
ডাক্তার শামীমের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
কি হচ্ছে এসব?
এটা নিশ্চিত যে নার্সের খুনের সাথে এই কেসের গভীর সম্পর্ক। একিই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু শারমিনকে খুন করবে কেনো? কে এই সিরিয়াল কিলার?
খুনি যেইহোক আরিফ সাহেব না এটা নিশ্চিত। হতে পারে উসমান বা করিমের মধ্যে কেউ।
সাত পাঁচ ভাবছি ঠিক এমন সময় আমার কাছে আরো একটা কল আসলো।
কন্সটেবল আসিফের কল।
আসিফকে বলেছিলাম উসমান এবং করিম সম্পর্কে খোঁজ নিতে।
কলটা ধরলাম। আসিফ বললো,
–মেহরাব স্যার, আমি ওদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে নিয়েছি।
করিম যে মায়া হকের বাসায় কাজ করতো, ও এখন ঢাকায় অন্য একটা বাসায় কাজ করে। কিন্তু স্যার অবাক করা বিষয় হচ্ছে করিমের গ্রাম থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম মাঝেমধ্যেই তাদের গ্রামের কবরস্থান থেকে লাশ চুরি হয়ে যায়।
আর উসমান সাহেব, যিনি মায়া হকের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন, উনি এখন একলা অন্য একটা ছোট বাসায় ভাড়া থাকেন। উনার স্ত্রী উনার সাথে থাকেন না। কিন্তু উসমান সাহেবকেও মাঝেমধ্যে অনেক লোক রাতে কবরস্থানের দিকে যেতে দেখেন। কেনো কবরস্থানে যান এটা কেউ জানেনা"।
কন্সটেবল আসিফের কথা শুনে আমার বুকের ভিতর ধড়াম করে একটা আওয়াজ হলো। তাহলে কি উসমান বা করিমের মধ্যে কেউ এই ভয়ংকর খুনগুলো করেছে"?
.
.
.
~ মেহরাব নয়ন
মেহরাব নয়নের রহস্য গল্প - "ইন্দ্রিয় লালসা-৩" মেহরাব নয়নের রহস্য গল্প - "ইন্দ্রিয় লালসা-৩" Reviewed by সার্থান্বেষী on জুন ২৯, ২০২০ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Copyright 2020, All Rights Reserved by Blog Sarthanweshi

Blogger দ্বারা পরিচালিত.