মেহরাব নয়নের রহস্য গল্প - ইন্দ্রিয় লালসা- শেষ পার্ট
ইন্দ্রিয় লালসা- শেষ পার্ট
–মেহরাব স্যার, আমি ওদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে নিয়েছি।
করিম যে মায়া হকের বাসায় কাজ করতো, ও এখন ঢাকায় অন্য একটা বাসায় কাজ করে। কিন্তু স্যার অবাক করা বিষয় হচ্ছে করিমের গ্রাম থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম মাঝেমধ্যেই তাদের গ্রামের কবরস্থান থেকে লাশ চুরি হয়ে যায়।
আর উসমান সাহেব, যিনি মায়া হকের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন, উনি এখন একলা অন্য একটা ছোট বাসায় ভাড়া থাকেন। উনার স্ত্রী উনার সাথে থাকেন না। কিন্তু উসমান সাহেবকেও মাঝেমধ্যে অনেক লোক রাতে কবরস্থানের দিকে যেতে দেখেন। কেনো কবরস্থানে যান এটা কেউ জানেনা"।
কন্সটেবল আসিফের কথা শুনে আমার বুকের ভিতর ধড়াম করে একটা আওয়াজ হলো। তাহলে কি উসমান বা করিমের মধ্যে কেউ এই ভয়ংকর খুনগুলো করেছে?
আসিফকে বললাম,
–তুমি উসমান এবং করিমের বাড়ির সব জায়গায় চেক করো। দেখো মানুষের কোনো অঙ্গ, অথবা চুড়ি চেইন এগুলো পাওয়া যায় কি'না।
কিছু পেলে সাথে সাথে আমাকে জানাও। সাথে করিম আর উসমানকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় নিয়ে আসো"।
–ঠিক আছে স্যার"।
.
কন্সটেবল আসিফের সাথে কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি থানা থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য নার্স শারমিনের বাসা। যে মাত্রই খুন হয়েছে।
আমি নিশ্চিত, নার্স শারমিন জানতো এই ভয়ংকর খুনের পিছনে কে আছে।
হয়তো এটার জন্যে তাকেও খুন করা হয়েছে।
.
নার্সের বাসায় পৌছালাম। দেখলাম গেইটের সামনে ডাক্তার শামীম দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। আমাকে দেখামাত্র ডাক্তার শামীম দৌড়ে এসে বললেন,
–মেহরাব স্যার আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একের পর এক খুন। কি হচ্ছে এসব স্যার? আমার ভীষণ ভয় লাগছে"।
–ভয় পাবেন না। খুনি যেইহোক, খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে। আপাতত চলুন শারমিনের লাশটা দেখে আসি"।
ভিতরে আসলাম। আমার সামনেই পড়ে আছে নার্স শারমিনের লাশ। লাশটা দেখে আমি মোটেও অবাক হইনি। একিই ভাবে খুন।
গলা কেটে হত্যা।
খুনের পর লাশের সাথে শারীরিক সম্পর্ক। এটা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মায়া হক এবং শারমিনের খুনিই একজন'ই।
কিন্তু কে করছে এসব?
করিম না'কি উসমান?
এই দু'জন ছাড়া তৃতীয় কারো উপর আঙুল তুলার কোনো সুযোগ নেই।
আমি নিশ্চিত, খুনি এই দু'জনের মধ্যেই কেউ।
শারমিনের লাশটা পোস্টমর্টেম করার জন্য পাঠিয়ে থানায় চলে আসলাম।
আপাতত করিম এবং উসমানকে ধরে থানায় নিয়ে আসাটা জরুরী"।
.
.
উসমানকে ধরে থানায় নিয়ে আসলাম।
অবশ্য উসমানকে ধরতে মোটেও খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। সে তার বাসাতেই ছিলো।
উসমান, মায়া হকের আগের ভাড়াটিয়া। যার তীব্র রাগ ছিলো মায়া হকের উপর।
রাগ থেকে হয়তো মায়া হককে এরকম ভয়ংকর খুন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মায়া হকের মেয়ে সামিয়া এবং নার্স শারমিনকে খুন করলো কেনো এটা এখনো পরিষ্কার না।
তারচাইতেও অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই মানুষটাকে দেখে কোনোদিক থেকেই এরকম ভয়ংকর খুনি মনে হচ্ছেনা। শরীরে পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি।
হুজুর হুজুর একটা ভাব।
এই মানুষটা এরকম ভয়ংকর নোংরা খুন করবে ভাবতেই পারছিনা।
আমি কথা বলা শুরু করলাম,
–তো নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত উসমান সাহেব, কেমন আছেন"?
আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। খানিকক্ষণ পর বললেন,
–নেক্রোফিলিয়া কি স্যার? কোনো বড় অপরাধের নাম না'কি"?
কথাটা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। বললাম,
–বাদ দিন এসব। আমাকে এটা বলুন মায়া হক এবং উনার মেয়ে সামিয়া যেদিন খুন হয়, ওইরাতে আপনি ওসমানীনগর হসপিটালে কি করছিলেন? অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন না, আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে"।
–কি অদ্ভুত। আমি অস্বীকার কেনো করবো স্যার? আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাক্তার দেখাতে।
ইদানিং আমার পেটের ডান সাইডে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি। ঠিকমতো দাঁড়াতে গেলে কষ্ট হয়। আমি এটার জন্যই ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।
আপনি চাইলে আমার সব রিপোর্ট দেখতে পারেন। অথবা ওইখানে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছি তার সাথেও কথা বলতে পারেন"।
–আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু আপনি মায়া হকের কেভিনে গেলেন কেনো এটা তো আমার মাথায় ঢুকছেনা"।
–স্যার আমি যখন হসপিটাল থেকে বের হতে যাবো ঠিক এমন সময় দেখলাম রাজু একটা কেভিন থেকে বের হলো। রাজুকে দেখে আমার মনে হলো হয়তো রাজুর আম্মা মায়াও এখানে আছে।
আসলে আমার ভিতরে আমার করা পাপের জন্য প্রচন্ড অপরাধ'বোধ কাজ করছিলো। কি'রকম জঘন্য মানুষ ছিলাম আমি। ভাবতেও ঘিন্না লাগে।
আমার পাপের জন্য আমার স্ত্রী'ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
আমি ভাবলাম মায়ার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। এজন্য আমি ওই কেভিনে যাই। গিয়ে দেখি মায়া তার মেয়ে সামিয়াকে নিয়ে একটা বেডে বসে আছে।
আমি মায়ার কাছে গিয়ে আমার পাপের জন্য ক্ষমা চাই। মায়াও আমাকে ক্ষমা করে দেয়। তারপর আমি হসপিটাল থেকে সরাসরি বাসায় চলে আসি"।
.
উসমান সাহেবের কথা শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
হতে পারে উনি সত্যি বলছেন, আবার হতে পারে আমাকে বোকা বানাচ্ছেন।
ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা।
আমি বললাম,
–ওকে! আপনার সব কথা বিশ্বাস করে নিলাম। কিন্তু আমাকে এটা বলুন, প্রায় রাতে আপনাকে কবরস্থানের দিকে যেতে দেখা যায়। অনেকজন সাক্ষী আছেন এই বিষয়টার।
রাতের অন্ধকারে কবরস্থানে গিয়ে কি করেন? লাশের সাথে নোংরামি"?
আমার কথাটা শুনে প্রচন্ড রেগে গেলেন উসমান সাহেব। রাগী কন্ঠে বললেন,
–ছিঃ! কি বলছেন এসব?
আমার সম্পর্কে এতো খোঁজ নিলেন, কিন্তু এটা জানলেন না যে 'আমার আম্মা ৪মাস আগে মারা গেছেন'। আমি প্রচন্ড ভালোবাসি আমার আম্মাকে।
রাত হলে বিছানায় ঘুমাতে পারিনা।
মনে'হয় ওই অন্ধকার জায়গায় আমার আম্মা কিভাবে থাকবেন? কিভাবে ওই অন্ধকারে একলা ঘুমাবেন?
এজন্য প্রায় রাতেই আমি আম্মার কবরে যাই। অনেক রাত ওইখানেই কাটিয়ে দেই। নিজের ভুল আর পাপের জন্য কান্নাকাটি করি"।
–আপনার মা মারা গেছেন? এজন্যই কবরস্থানে যান?
–জ্বী স্যার। আপনি চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। বিশ্বাস করুন, আমার কথায় বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই।
আমি কোনো কথা মিথ্যা বলিনি"।
.
উসমান সাহেবের সাথে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। উনাকে ছেড়ে দিয়ে উনার সম্পর্কে আরেকটু ভালোভাবে খোঁজ নিলাম।
আসলেই সব সত্যি বলেছেন।
ওইদিন হসপিটালে উনি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। উসমান সাহেবের মা মারা গেছেন ৪মাস আগে। মা মারা যাওয়ার পর উসমান সাহেব পুরোপুরি বদলে গেছেন। সহজ বাংলায় এখন তাকে একজন "ভালো মানুষ' বলা যায়। এটার মানে হচ্ছে উসমান সাহেব এই ভয়ংকর খুনগুলো করবেন না।
তাহলে খুনিটা কে?
আমার হাতে আছে স্রেফ একজন।
"করিম"। যে মায়া হকের বাসায় আগে কাজ করতো।
.
করিম সম্পর্কে একটু খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারলাম করিম মায়া হকের বাসা থেকে কাজ ছেড়ে দিয়েছিলো কেনো।
করিমের একটা মেয়ে আছে। ফাতিমা।
বয়স ৯। কয়েক'মাস আগে ফাতিমা একটা হসপিটালে মারা যায়। শুধুমাত্র টাকার অভাবে কিডনির অপারেশন করা হয়নি এজন্য।
পাশের ফ্ল্যাটে কাজ করা ছেলেটার কাছে যখন বিষয়টা জানতে চাইলাম, তখন ছেলেটা বললো,
" স্যার, করিম ভাই বহুত কান্নাকাটি কইরা মায়া ম্যাডামের কাছে কইছিলো টাকা দেওয়ার জন্য। কিন্তু মায়া ম্যাডাম টাকা দেন নাই। এতোগুলান টাকা না'কি উনি দিতে পারবেন না।
করিম ভাই আমার কাছে এসে বহুত কান্নাকাটি করছে। আমিও গরীব মানুষ স্যার। কি করমু? বেচারা মাইয়াটারে বাছাইতে পারে নাই। আহ!
তারপর এই বাসায় আর কাজ করে নাই"।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মায়া হকের উপর করিমের রাগ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। আর এই ধরনের রোগী'রা রাগ থেকে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
হয়তো এই ভয়ংকর খুনগুলো করিম'ই করেছে"।
.
.
করিমকে ধরে থানায় নিয়ে আসলাম।
করিমকে খুঁজে বের করতে একটুও কষ্ট হয়নি। ২মাস ধরে যে নতুন বাসাটায় কাজ করছে ওইখান থেকেই ধরেছি।
আমি করিমের চেহারার দিকে একবার ভালোভাবে তাকালাম।
ভীত চেহারায় চুপচাপ বসে আছে।
কথা বলা শুরু করলাম,
–তো করিম মিয়া! মায়া হকের উপর প্রতিশোধ তো খুব ভয়ংকর ভাবেই নিলে। এবার এটাও বলে দাও সামিয়া এবং নার্সকে খুন করলে কেনো"?
কথাটা শুনে করিম মিয়া যেনো চমকে উঠলো। চেহারায় পাহাড় পরিমাণ ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
প্রচন্ড ভয়ার্ত কন্ঠে করিম বললো,
–কি কইতাছেন স্যার এগুলো?
আমি কোনো খুন টুন করিনি"।
–সব খুনিই এটা বলে। তুমি যদি খুন না'ই করে থাকো, তাহলে ওইরাতে ওসমানীনগর হসপিটালে মায়া হকের কেভিনে কি করছিলে?
তোমার এলাকার কবরস্থান থেকে লাশ চুরি হয়ে যায় কোথায়?
তুমি'ই খুনগুলো করেছো।
তুমি'ই লাশের সাথে এসব নোংরামি করেছো। স্বীকার করে নাও করিম মিয়া! অন্যথায় কিভাবে স্বীকার করাতে হয় আমরা ভালো করেই জানি"।
আমার কথাগুলো শুনে করিম মিয়া হু হু করে কান্না শুরু করলো।
কান্নার মধ্যেও চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। করিম মিয়া কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বললো,
–স্যার আমি কিছু করিনি।
আমারে ছাইড়া দেন স্যার।
ওইরাতে তো আমি আমার নতুন বাসার মালিকের খাবার নিয়া হাসপাতালে গেছিলাম। মায়া ম্যাডামের পাশের কেভিনে এখন উনি ভর্তি আছেন।
উনার কি একটা অপারেশন হইছে স্যার।
ওইদিন খাবার দিয়ে আসার পথে আমি জানালা দিয়ে দেখলাম সামিয়া মানে মায়া ম্যাডামের মাইয়া শুইয়া আছে।
আমারো তো সামিয়ার মতোন একখান মাইয়া আছিলো স্যার। তাছাড়া আমি সামিয়া ম্যাডামরে নিজের মেয়ের মতোন'ই দেখতাম। সামিয়া ম্যাডামরে জানালা দিয়া দেইখা আমি তাড়াতাড়ি কেভিনে যাই৷ গিয়ে দেখি সামিয়ার পাশে বসে মায়া ম্যাডাম কান্নাকাটি করতাছেন। আমারে দেইখাও কান্না করলেন। আমার কাছে মাফ চাইলেন।
কইলেন আমি যেনো তাকে মাফ কইরা দেই। আমার মেয়ের মরার জন্য উনি নিজেকে দোষ দিচ্ছিলেন স্যার।
আমি কইলাম "ম্যাডাম জন্ম আর মরণ তো আল্লাহর হাতে। আমার মেয়ের মরণ হয়তো এভাবেই লিখা ছিলো। আপনার উপর আমার আর কোনো কষ্ট নাই"।
তারপর উনি আমারে অনেকগুলা টাকা দিতে চাইলেন। আমি আনিনি স্যার।
এহন টাকা দিয়া আমি কি করুম?
তারপর সামিয়া ম্যাডামরে দেইখা আমি ওইখান থেকে আইয়া পড়ি।
আর শারমিন কে স্যার? আমি'তো চিনিওনা তাকে। স্যার আমারে ছাইড়া দেন। আমি কিছু করিনি"।
.
করিম ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। তার চোখের পানিগুলো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে সত্যি বলছে। তারপরেও আমি খুব করে চাই যাতে করিম দোষী হোক।
কারণ করিম ছাড়া আমার হাতে আর কোনো মানুষ নেই। অন্য কারো উপর আঙুল তুলার কোনো সুযোগ ও নেই।
আমি বললাম,
–আচ্ছা বিশ্বাস করে নিলাম তুমি ওইদিন তোমার বাসার মালিকের জন্য খাবার নিয়ে গেয়েছিলে। এটাও মানলাম সামিয়াকে দেখে ওই কেভিনে গেছো।
কিন্তু তোমার গ্রামের কবরস্থান থেকে লাশ চুরির বিষয়টা? তোমাদের গ্রামের কবরস্থান থেকে লাশ যায় কোথায়?
তুমি'ই লাশের সাথে এসব নোংরামি করো। সত্যিটা বলে দাও"।
করিম কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–স্যার কি কন এসব?
আমাগোর গ্রামে লাশ চুরি হইতাছে ঠিক।
কিন্তু এটা নিয়া পুলিশরা আলাদা কাজ করছে স্যার। শুধু আমাদের না, পাশের গ্রাম থেকেও লাশ চুরি হইতাছে।
শুনতাছি কোনো একটা চক্র না'কি লাশ চুরি কইরা বড় দামে বেইচা দেয়।
তাছাড়া আপনি খোঁজ নিলে জাননে পারবেন মাইয়াগো লাশের চাইতেও পুরুষদের লাশ বেশি চুরি হইতাছে।
আমার কথা বিশ্বাস করের স্যার।
আমি এতটাও খারাপ লোক না।
আসল খুনিরে না ধইরা আমার মতো অসহায় মানুষরে ফাসাইয়েন না স্যার।
আমি গরীব মানুষ"।
করিম অবিরাম কান্না করে যাচ্ছে।
প্রচন্ড মায়া লাগছে ওর কান্না দেখে।
আমার এক'মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি করিম মিথ্যা বলছে। মানুষ মিথ্যা বলতে পারে, কিন্তু মানুষের চোখ নয়"।
.
করিমকে ছেড়ে দিলাম।
খোঁজ নিয়ে দেখলাম করিমের প্রত্যেকটা কথা সত্য। মিথ্যা বলেনি।
এখন আমার নিজেকেই প্রচন্ড অসহায় মনে হচ্ছে।
কি হলো এসব?
এতো কষ্টের পর ফলাফল শূন্য?
কিন্তু কেউ তো এই ভয়ংকর খুনগুলো করেছে। আরিফ সাহেব না, উসমান সাহেব না, করিম মিয়া না,
তাহলে খুনিটা কে?
এতোদিন ধরে আমি শুধু সিসিটিভি ফুটেজটার উপরেই খুনিকে ধরার চেষ্টা করেছি। ভুলটা হয়তো এখানেই।
সিসিটিভি থেকে বেরিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। মায়া হকের জীবনের পুরো ইতিহাসটা আমাকে জানতে হবে"।
.
মায়া হকের অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর জানতে পারলাম উনি মেডিকেলে পড়তেন। একটু খোঁজাখুঁজির পর উনার কলেজ লাইফের একটা গ্রুপ ছবি পেলাম। ছবিটার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। ছবির কর্নারে ডাঃ শামীম দাঁড়িয়ে আছেন।
এটার মানে হচ্ছে ডাঃ শামীম আগে থেকেই মায়া হককে চিনতেন।
কিন্তু আমাকে তো কখনো বলেন নি এসব। কিছু গন্ডগোল আছে।
.
মায়া হকের কলেজ লাইফের কয়েকজন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা আমাকে বললো,
"স্যার মায়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতো শামীম। কোনো ছেলে মায়ার সাথে কথা বলা তো দূর, মায়ার দিকে তাকালেই তার সাথে মারামারি শুরু করে দিতো। শামীমের এসব পাগলামি মায়ার লাইফটা একদম বিরক্তিকর করে তুলছিলো।
একদিন মায়া এসবের জন্য শামীমের সাথে কথা বলে। শামীমকে বুঝায়।
কিন্তু শামীমের একটাই কথা 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'। শামীমকে বুঝাতে না পেরে মায়া শামীমের গালে একটা থাপ্পড় মারে। ব্যাস তারপর তো মায়াও প্রচন্ড ভয়ে দিন কাটাতে শুরু করে। পড়াশুনাও কমপ্লিট না করে বাবার কথা অনুযায়ী বিয়ে করে নেয়।
এই পাগলটার জন্য আমরাও সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কখন কি করে ফেলে এটার ঠিক ছিলোনা স্যার"।
.
আমার কাছে কেসটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হওয়া শুরু করলো।
আমি ডাক্তার শামীম সম্পর্কে আরেকটু খোঁজ নিলাম।
মেডিকেলে পড়ার সময় প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট শামীমকে ভয় পেতো।
অনেকে 'সাইকো' বলেও ডাকতো।
মায়ার ওই থাপ্পড়ের পর পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে, শামীমের সাথে কেউ কথা বলতে আসলে বা তার শরীরের সাথে ভুল করে কারো শরীর টাচ হলে সে তাকে ভয়ানক'ভাবে মারধর করতো।
শামীমের বাবা রাজ্জাক সাহেব।
ফ্রান্স থাকেন। বড় বিজনেসম্যান। ছেলের এই অবস্থার কথা শুনে ছেলেকে তার কাছে ফ্রান্সে নিয়ে যান।
ওইখানে প্যারিসের একটি হসপিটালে তার মানসিক চিকিৎসা করা হয়"।
.
আমি বিষয়টা আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই সময়ের প্যারিস হসপিটালের হেড ডাক্তার ক্লিনটনের সাথে যোগাযোগ করি। শামীমের নাম শুনতেই ডাক্তার ক্লিনটন বলেন,
–শামীম? ওই বাংলাদেশি ছেলেটা?
ও কি আবার কোনো লাশের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছে"?
ডাক্তার ক্লিনটনের কথা শুনে হাই ভোল্টেজের শকড খেলাম। বললাম,
–মানে? শামীম কি প্যারিসেও এগুলো"?
–হ্যা। আমরা একবার নয়, হাতেনাতে দুইবার ধরেছি। সে লাশের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছিলো।
শামীম নেক্রোফিলিয়াতে আক্রান্ত।
আমরা তো তার হাত পা বেঁধে তাকে চিকিৎসা করেছিলাম।
কিন্তু আমরা তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তারপর হসপিটাল থেকে রিলিজ দেই।
ওর কি আবার নেক্রোফিলিয়া এট্যাক করেছে"?
ডাক্তার ক্লিনটনের কথা শুনে আমার কাছে বিষয়টা পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেলো। কাঁপা কন্ঠে বললাম,
–ডাক্তার সাহেব, কি কি কারণে নেক্রোফিলিয়া হতে পারে? বা এই রোগটা আবার কি কি কারণে ব্যাক করতে পারে"?
–রাগ, ডিপ্রেশন, অতৃপ্ত যৌন জীবন। অনেক কারনেই নেক্রোফিলিয়া হয়ে থাকে। আবার এই ধরণের মানুষদের ভয়ংকর পরিমাণ রাগ থাকে।
যাদের উপর তাদের রাগ হয়, তারা ওই মানুষটার সাথে নোংরামি না করা পর্যন্ত শান্তি পায়না। হতে পারে এরকম কোনো মানুষকে দেখলে নেক্রোফিলিয়া আবার এট্যাক করতে পারে"।
–ধন্যবাদ ডাক্রার। আমি আপনাকে পরে কল দিয়ে সব বিস্তারিত বলছি"।
–ওকে"।
.
ডাক্তার ক্লিনটনের সাথে কথা বলার পর আমার কাছে পুরো বিষয়টা একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো। হসপিটালের সিসিটিভি বন্ধ হওয়া।
নার্স শারমিনের খুন। সব এখন পরিষ্কার।
.
ডাক্তার শামীমকে ধরে থানায় নিয়ে আসলাম। আমার সামনে বসে আছেন ডাক্তার শামীম। নিঃশব্দ।
হয়তো ধারণা করতে পেরেছেন উনার সব খেলা আমি ধরে ফেলেছি।
ডাক্তার শামীম ঢোক গিলে বললেন,
–আমাকে এখানে নিয়ে আসলেন কেনো মেহরাব স্যার? খুনি কি ধরা পড়েছে"?
আমি খিক খিক করে হেসে উঠলাম।
বললাম,
–অভিনয়টা বেশ ভালোই পারেন।
হ্যা খুনি ধরা পড়েছে। উনি আমার সামনেই বসে আছে"।
কথাটা শুনে মুহুর্তেই ডাক্তার শামীমের চেহারাটা ভীত হয়ে গেলো।
আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ঢোক গিললেন। কাঁপা কন্ঠে বললেন,
– মানে? কি বলছেন এসব"?
আমি মায়ার কলেজের গ্রুপ ফটোটা ডাক্তার শামীমের সামনে রাখলাম। বললাম,
–আপনার কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে প্যারিস হসপিটালের ডাক্তার ক্লিনটন পর্যন্ত সবকিছু আমি জেনে গেছি। বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।
আপনাকে ভালো একটা পরামর্শ দেই, দোষ এখানেই স্বীকার করে নিন। অন্যথায় রিমান্ডে নিয়ে গেলে বুঝতেই তো পারছেন"।
ডাক্তার শামীম মাথা নিচু করে বসে রইলেন। কোনো কথা বলছেন না।
একদম চুপচাপ।
মিনিট'খানেক পর আমি আবার বললাম,
–দোষ কি স্বীকার করবেন"?
ডাক্তার শামীম চিল্লায়া উঠলেন,
–হ্যায়ায়ায়া আমি খুন করেছি ওদের।
আমিইই খুন করেছি।
ওইদিন যখন মায়াকে হসপিটালে দেখলাম, আমি জানিনা আমার মাথায় কি হলো। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছিলো মাথার ভিতর। আমার মুহুর্তেই সেই আগের দিনগুলো মনে পড়ে গেলো।
অনেক বেশি ভালোবাসতাম এই মায়াকে। সবার সামনে বলেছিলাম আমার ভালোবাসার কথা।
কিন্তু ও কি করলো? আমাকে সবার সামনে থাপ্পড় মারলো।
বাদ দিলাম এসব। ভাবলাম ভালো একটা ক্যারিয়ার হওয়ার পর বিয়ের প্রস্তাব দিলে হয়তো মেনে যাবে।
আমি পড়াশুনায় মন দিলাম।
কিন্তু মায়া কি করলো? ও অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করে নিলো।
বিয়ের রাতেও আমি ওর বাসায় যাই।
সবার সামনে কান্নাকাটি করে বলি যাতে আমাকে বিয়ে করে নেয়। আমি ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
মায়া কি করলো জানেন?
সবার সামনে আমাকে আবারো থাপ্পড় মারলো। শুধু এটাই না, আমার মুখে থুউ দিয়ে বললো "তোর মতো সাইকো'কে কে বিয়ে করবে"?
ওইদিন মায়াকে হসপিটালে দেখার পর আমি জানিনা আমার কি হয়েছিলো।
আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।
রাত সাড়ে ১২টায় আমি হসপিটালের সমস্ত সিসিটিভি অফ করি।
মায়ার কেভিনে যাই।
দেখি মায়া এবং সামিয়া একুটা বেডে ঘুমাচ্ছে। রাজু অন্য বেডে।
আমি রাজুকে ঘুমের মধ্যেই অজ্ঞান করি।
তারপর মায়ার উপর আমার সমস্ত রাগ শেষ করি। ওর মেয়েটাকে আমার খুন করার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা।
কিন্তু মায়াকে খুন করার সময় সামিয়া জেগে যায়৷ আমাকে দেখে ফেলে।
বেড থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে। তারপর আমি সামিয়াকেও খুন করে দেই।
আমি খেয়াল-ই করিনি জানালাটা খুলা ছিলো। ওদের খুন করার সময় নার্স শারমিন আমাকে দেখে নেয়।
আমি শারমিনকে অনেক টাকা দিয়ে আমার প্ল্যানে সামিল করি।
যে ছুরি দিয়ে আমি খুন করি, সেটা রাজুর হাতে ধরিয়ে দেই।
শারমিনকে বলি ও যেনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাজুর জ্ঞান ফিরলে সাথেসাথে যেনো চিৎকার দেয়। সবকিছু ঠিক ছিলো।
কিন্তু এই শালির অল্পতে পেট ভরেনা। আমার কাছে অনেকগুলো টাকা চেয়ে বসলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যদি শারমিন বেঁচে থাকে, তাহলে আমাকে আজীবন ব্ল্যাকমেইল করবে। তাই আমি শারমিনকেও খুন করে দিলাম।
আর লাশ দেখলে আমি জানিনা আমার কি'হয়। আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনা"।
.
ডাক্তার শামিমের কথা শুনে উনার দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলাম।
এখনো রাগে ফুসফুস করছেন।
মোটেও অনুতপ্ত নন।
আমি বললাম,
–শারমিন আপনাকে আজীবন ব্ল্যাকমেইল করতো কি'না জানিনা। তবে আমি এটা জানি, আপনাকে আজীবন এখন এই কারাগারেই থাকতে হবে।
কন্সটেবল আসিফকে ডাক দিয়ে বললাম,
"রাজুকে ছেড়ে দাও। আর ডাক্তার শামীমকে জ্বেলের ভিতর নিয়ে যাও"।
"ঠিক আছে স্যার"।
.
বড় একটা নিশ্বাস নিলাম।
চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছি।
এই দুনিয়াটা কতোটা অদ্ভুত।
কতো রকমের মানুষ আছে আমাদের চারপাশে। চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছি ঠিক এমন সময় আমার মোবাইলটা বেঁজে উঠলো। আমার স্ত্রী মিহির কল।
ধরলাম। মিহি বলল,
–সারাদিন আসামীদের সাথে থাকতে থাকতে তোমার 'মন' বলে কিছু রয়েছে মেহরাব? আচ্ছা সত্যি করে বলো'তো, মিহি নামে তোমার যে একটা বউ আছে, এটা কি তোমার মনে আছে"?
আমি ফিক করে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
" তুমি আমার এমন'ই একজন,
যাকে আজীবন চাইলেও ভুলতে পারবেনা এই মন"।
মিহি অনেক জোরে হেসে উঠলো।
আনন্দের হাসি।
কি ভয়ানক এই সুন্দর হাসি।
ঠিক এই মুহুর্তে আমার মনের ভিতরেও অদ্ভুত এক আনন্দ কাজ করছে। এটা মিহির হাসি শুনে, না'কি বড় একটা কেস সমাধান করে, আমি জানিনা।
উহহু! এক জীবনে সবকিছু জানতে হয়না। জীবনটা এভাবেই চলুক। চলতেই থাকুক...
সমাপ্ত
~ মেহরাব নয়ন
মেহরাব নয়নের রহস্য গল্প - ইন্দ্রিয় লালসা- শেষ পার্ট
Reviewed by সার্থান্বেষী
on
জুন ২৯, ২০২০
Rating:
কোন মন্তব্য নেই: