সিস্টার সিটি ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

Add caption

সিস্টার সিটি হল একটি দেশে উন্নত সিটির আদলে,  চুক্তি হওয়া দেশের অনুন্নত এক বা একাধিক শহরের পরিকাঠামো গড়ে তোলা। এই ধারণার মূলকথা হলো ভবন, সড়ক, পরিসেবার পাশাপাশি উভয় সিস্টার সিটির নাগরিকদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এবং যোগাযোগ  বাড়ানোর চেষ্টা করা। এটার কার্যক্রম শুরু হলে প্রকারান্তরে দুই দেশের মধ্যে তৈরি করে দেবে একটা অসাধারন নাগরিক কূটনীতি বা সুসভ্য সিটিজেন ডিপ্লোমেসি।
আজকাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে চীনের দেওয়া বড় অংকের ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ঋণগ্রহীতা দেশগুলো। ফলে দেশগুলোর ঘাড়ে চেপে বসছে ঋণের বোঝা। দেশগুলো চীনের হাতে তুলে দিচ্ছে ভূমি, বন্দর, এমনকি বিমানবন্দর।এতে করে চীনের বিস্তৃত কৌশলগত ও সামরিক উচ্চাকাঙ্খা বাস্তবায়নের পথ সুগম হচ্ছে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৬টি দেশ চীনের কাছ থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি ও মালয়েশিয়া।  চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানে ৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০১৪ সালে কেনিয়া তার দেশের স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য চীনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল৷ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, এই রেলপথ যদি ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে না পারে তবে মোম্বাসা বন্দর সহ কেনিয়া পোর্ট অথরিটির সম্পদ চীনের দখলে চলে যাবে৷ এই রেল প্রকল্প থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উঠে আসার কোনও সম্ভাবনা আছে কি না, তা নিয়ে সে সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল৷ বাস্তবেও দেখা গিয়েছিল, প্রথম বছরেই এই প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন শিলিং (কেনীয় মুদ্রা) লোকসান হয়েছিল৷  যা পরিস্থিতি তাতে ঋণ খেলাপির দায়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মোম্বাসা বন্দর চীনের দখলে চলে যাবে৷
পাকিস্তানের অনেক বিশেষজ্ঞ এই বড় অংকের ঋণ সুদসহ কিভাবে ইসলামাবাদ শোধ করবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন খাতে এরই মধ্যে চীনের কাছ থেকে ১৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান।

আবার চীন শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটায় ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে একটি চুক্তি করেছে।শ্রীলঙ্কার সরকার যখন চীনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলো তখন চুক্তি অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি চীনা কোম্পানি ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর  ৯৯ বছরের জন্য বন্দর এবং তার সংলগ্ন ১৫,০০০ একর জমি শিল্পাঞ্চল তৈরির জন্য ইজারা নিয়ে নিয়েছে।এই পরিকল্পনার ফলে হাজার-হাজার গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করতে হবে। 
ভারত মহাসাগরের এই হাম্বানটোটা বন্দরটি চীনের বেল্ট এন্ড রোড পরিকল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে। নতুন সিল্ক রোড নামে পরিচিতি পাওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এবং ইউরোপের মধ্যকার বন্দর ও রাস্তাগুলোর মধ্যে সংযোগ দেয়া হবে।
এদিকে প্রকল্পটির দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান এবং ভারত।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কম্বোডিয়ায় চীন ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া গত দুই দশকে চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণতো রয়েছেই। দেশটির বিদেশি ঋণের ৬০ শতাংশই নেওয়া হয়েছে বেইজিংয়ের কাছ থেকে। ঋণে জর্জরিত কম্বোডিয়ার কাছ থেকে চীনা অভিবাসীরা দেশটির কৃষি জমির বড় অংশের মালিকানা নিয়েছেন। চীন দেশটির নতুন রেলওয়ে লাইনের জন্য ৬.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
অস্ট্রেলিয়ার কাছের দেশ পাপুয়া নিউ গিনির সরকার হয়ত চীনের কাছে তেল, সোনা, কপার ও কফি ক্ষেত্র তুলে দিতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। চীন এরই মধ্যে দেশটির নিকেল খনির বড় অংশের মালিকানা পেয়ে গেছে এবং সড়ক, বন্দর ও উচ্চগতির ইন্টারেনেটে বিনিয়োগ করছে। গত পাঁচ বছরে চীনের কাছ থেকে নেওয়া অংশ দাঁড়িয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ভানুয়াতুর বিদেশি ঋণের অর্ধেকই দিয়েছে চীন। সেখানে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে বেইজিং।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি আজ মহাসংকটে। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতির এতো খারাপ অবস্থা বিশ্ববাসী আর লক্ষ্য করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বে সবচেয়ে সংকটে পড়বে দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহ। আমরা জানি বিশ্ব একটা সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বব্যাপী ক্রমান্বয়ে চীন তার কর্তৃত্ব বাড়িয়ে তুলেছে এবং দিনে দিনে মার্কিন আধিপত্য সংকুচিত হতে শুরু করেছে। 

করোনাভাইরাস আসার পূর্বেই আমরা দেখতে পায় চীনের কাছ থেকে যে সকল দেশ ঋণ গ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে কিছু কিছু রাষ্ট্র যেমন শ্রীলংকা ,পাকিস্তান,
কম্বোডিয়া,কেনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলো অর্থসংকটে পড়ে গেছে। 
করোনা কালীন সময়ে প্রতিটি দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও যখন গ্রহীতা দেশ দাতাদেশ চীনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতেে না পারায় তাদের বিভিন্ন  ভূখণ্ড, দ্বীপ,সমুদ্র বন্দর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণণ স্থাপনাসমূহ চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে সেখানে করোনা পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিটি ঋণগ্রহীতা দেশ চীনের নিকট পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তুলে দিতে বাধ্য হবে, যার মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকায় নতুন করে চীনের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর কর্তৃত্ব দারুনভাবে হ্রাস পাবে। পাশাপাশি চীনা বিশ্বব্যাংক নামে পরিচিত AIIB মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতার মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে।

ঠিক এমতোবস্থায় চীন সরকার বিগত 19 জুন 2020 সালে এক ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ মহলের সাথে  আলোচনায় বসেছেন এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। যেখানে চীন সরকার বাংলাদেশকে সিস্টার সিটি নীতির আওতায় লোভনীয় অফার দিয়েছেন। এই অফার বাংলাদেশের জন্য বাহ্যিক অর্থে খুবই আকর্ষণীয়। চীন সরকার ভৌগোলিকভাবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করা ও ভারতকে চতুর্দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করার জন্যই এমন লোভনীয় অফার দিতে পারে। এই সুবিধার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে যেমনটা ঘটলো শ্রীলংকা-পাকিস্তান মালেশিয়া পাপুয়া নিউগিনির সাথে। 
তবে বলা যায়, চীন সরকার কঠিন কঠিন শর্ত গুলো শিথিল করলে এমন সুবিধা বাংলাদেশে গ্রহণ করতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ভালো গুরুত্ব বহন করে,  নিজেদের গুরুত্বকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে কিছু বিবাদপূর্ণ সমস্যা সমাধান করে নিতে পারে। ভারত সরকার তাতে রাজি না হলে , চীনের থেকে বড় মাপের অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সাথে ভারতকে চাপে রাখতে পারে বাংলাদেশ। 
সর্বোপরি বলা যায় বাংলাদেশের জন্য এক অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে ।

তাহমিদ চৌধুরী
tahmidchowdhury94@gmail.com 
সিস্টার সিটি ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা সিস্টার সিটি ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা Reviewed by সার্থান্বেষী on জুন ২২, ২০২০ Rating: 5

Post Comments

Copyright 2020, All Rights Reserved by Blog Sarthanweshi

Blogger দ্বারা পরিচালিত.